রপ্তানি ব্যবসা হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম একটি মাধ্যম। বৈশ্বিক বাজারে পণ্য রপ্তানি করে যে লাভবান হওয়া যায়, তা অনেকেই জানেন। কিন্তু অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না, কিভাবে পন্য রপ্তানি করতে হয়, বাংলাদেশ থেকে পন্য রপ্তানির পদ্ধতি কি,কিভাবে রপ্তানি ব্যবসা শুরু করতে হবে, রপ্তানি করতে কি কি কাগজপত্র লাগে, কোথা থেকে এসব কাগজপত্র নিবেন, কত টাকা লাগবে। আপনি কিভাবে আপনার পন্য রপ্তানি করবেন এটা জানতে চাইলে অথবা যদি রপ্তানি ব্যবসা শুরু করতে চান তাহলে আজকের আলোচনা আপনার জন্য।
রপ্তানি শুরু
করবেন যেভাবে
রপ্তানি ব্যবসা শুরু করতে প্রথমেই কিছু ধারনা রাখতে হবে। যেকোনো ব্যবসার জন্য যেমন TIN টিআইএন (কর সনাক্তকরণ নম্বর), ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন এবং ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই রপ্তানি ব্যবসার জন্যও কিছু বিশেষ ডকুমেন্ট এবং লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। রপ্তানি শুরু করার পুরো পক্রিয়াটি কয়েকটি
ধাপে আমরা ভাগ করেছি।
ধাপ ১: রপ্তানি লাইসেন্স তৈরি করা
রপ্তানি ব্যবসার প্রথম ধাপ হলো রপ্তানি লাইসেন্স (ERC) তৈরি করা। ERC এর পূর্নরূপ হল Export
Registration Certificate।
পন্য
রপ্তানি করতে গেলে সরকার থেকে রপ্তানির জন্য যে অনুমোদন পত্র লাগে তাই হল ERC। এটাকে
অনেকে রপ্তানি লাইসেন্স বলে থাকে।
রপ্তানি লাইসেন্সের বর্তমান ফি কত?
সরকার রপ্তানিকারকদের সহযোগিতায় সবসময় আগ্রহী, তাই রপ্তানি লাইসেন্সের ফি এখনও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ২০২৪ সালের সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী, রপ্তানি লাইসেন্স ফি বর্তমানে ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার মধ্যে নির্ধারিত হয়েছে, যার উপর ১৫% ভ্যাট প্রযোজ্য।
রপ্তানি লাইসেন্স পেতে কতদিন সময় লাগে?
রপ্তানি লাইসেন্স পেতে কতদিন সময় লাগবে, তা নির্ভর করবে আপনি কিভাবে
করবেন তার উপর। যদি আপনি নিজে সরাসরি আবেদন করতে চান, তবে এটি ১০-১৫ দিন সময় নিতে পারে। তবে, কোনো পেশাদার কনসালটেন্টের সাহায্য নিলে এটি ৩-৫ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে।
ধাপ ২: প্রোফর্মা ইনভয়েস (পি আই) তৈরি করা
ধরুন আপনি আপনি এখন পন্য রপ্তানি
করবেন। আপনার পন্য হল ১০০০ পিস টি শার্ট। রপ্তানি লাইসেন্স পাওয়ার পর আপনার পরবর্তী ধাপ হবে ক্রেতার জন্য একটি প্রোফর্মা ইনভয়েস (পি আই) তৈরি করা। প্রোফর্মা ইনভয়েস হলো একটি ডকুমেন্ট যেখানে পন্যের
সব বিবরন যেমন পরিমান, ধরন, দাম এবং অন্যান্য শর্তাবলী উল্লেখ থাকে। এখন আপনি যে পি
আই (PI) তৈরি করবেন সেখানে আপনার পন্য- টিশার্টের সকল বিবরন উল্লেখ করবেন।
পি আই ইস্যু করার পর তা আমদানিকারক
বা আপনার ক্রেতার কাছে পাঠাতে হবে। এটা ইমেইল বা ডকুমেন্ট কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠাবেন।
এই ডকুমেন্টের সাহায্যে আপনার ক্রেতা তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) ওপেন করতে পারবেন।
ধাপ ৩: ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করা
আপনার ক্রেতা যখন লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) ওপেন করবেন, তখন আপনার ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
একটা কথা বলে রাখি, রপ্তানি শুরু করার সময় আপনাকে একটি ব্যাংক নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে আপনি আপনার রপ্তানির টাকা লেনদেন করবেন। একে বলা হয় অ্যাডভাইজিং ব্যাংক। আপনার ক্রেতা যখন তার ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি ওপেন করবেন, তখন সেই এলসিটি আপনার অ্যাডভাইজিং ব্যাংকে পাঠানো হবে।
ব্যাংক থেকে আপনি এলসির একটি কপি এবং একটি এক্সপোর্ট ফর্ম (EXP ফর্ম) পাবেন, যেখানে পণ্যের বিবরণ, মূল্য, পরিমাণ ইত্যাদি তথ্য উল্লেখ থাকবে।
ধাপ ৪: পণ্য রপ্তানি করা
এলসি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আপনার পরবর্তী কাজ হলো পণ্য রপ্তানি করা। পণ্য রপ্তানি করতে হলে আপনাকে অবশ্যই একটি কাস্টম ক্লিয়ারিং এবং ফরওয়ার্ডিং (C&F) এজেন্ট নিযুক্ত করতে হবে। বলতে গেলে বাকি প্রায় সব কাজ
এই এজেন্টই করে দিবে।
C&F এজেন্টের কাজ হলো আপনার পণ্য কাস্টমস থেকে ক্লিয়ার করে তা শিপিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা। তারা পণ্যের ঘোষণাপত্র জমা দেয়া, কাস্টমস শুল্ক প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং শিপমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, যেমন বিল অব লেডিং (BL), ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট ইত্যাদি প্রস্তুত করে দিবে আপনাকে। আপনাকে সরাসরি শিপমেন্ট প্রক্রিয়া তদারকি করতে হবে না, কারণ C&F এজেন্ট এই কাজগুলো আপনার পক্ষে সম্পন্ন করে দিবে।
পণ্য যদি জাহাজে পরিবহন করা হয়, তবে এজেন্ট কন্টেইনার বুকিং থেকে শুরু করে বন্দরে পণ্য পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করবে। যদি পণ্য বিমানপথে পরিবহন করা হয়, সেক্ষেত্রে এজেন্ট আপনার হয়ে এয়ার কার্গো বুকিং, পণ্য বোর্ডিং এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবে।
শিপমেন্ট প্রক্রিয়ার সময় C&F এজেন্ট আপনাকে শিপমেন্টের প্রমাণ স্বরূপ বিল অব লেডিং দিবে, যা আপনার ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এই ডকুমেন্টের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হবে যে আপনার পণ্য সঠিকভাবে শিপ হয়েছে এবং ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্য পথে রয়েছে।
রপ্তানি পরিবহন খরচ কত?
বর্তমানে, একটি ২০ ফুট কন্টেইনার শিপিং করতে ৮০০ থেকে ১০০০ ডলার খরচ হতে পারে। বিমানে রপ্তানি করলে প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৬ ডলার খরচ হতে পারে। পরিবহন খরচ মূলত পন্যের ধরন
এবং কোন দেশে পাঠাবেন তার উপর নির্ভর করবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবহন খরচের সঠিক হার নিশ্চিত করার জন্য আপনার ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার বা শিপিং এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে নিবেন।
ধাপ ৫: কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দেয়া
রপ্তানি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আপনার কাজ হবে সমস্ত কাগজপত্র যেমন ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, প্রোফর্মা ইনভয়েস, বিল অব লেডিং ইত্যাদি ব্যাংকে জমা দেয়া। ব্যাংক এই ডকুমেন্টগুলো আপনার ক্রেতার ব্যাংকে পাঠাবে। আপনার ক্রেতা তার দেশের বন্দর
থেকে পন্য খালাস করতে এই কাগজগুলো দরকার হবে।
উপরের কাগজগুলো ব্যাংকে জমা
দেওয়ার পর ব্যাংক যখন নিশ্চিত হবে যে পণ্য রপ্তানি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে তখন এলসিতে
উল্লেখিত অর্থ আপনাকে পরিশোধ করবে। ডলার থেকে টাকা কনভার্ট করার জন্য ব্যাংক কিছু চার্জ
নেবে।
রপ্তানির পুরো পক্রিয়াটি সংক্ষিপ্তে
তুলে ধরা হল…
ERC বা রপ্তানি লাইসেন্স>
পি আই তৈরি করে পাঠানো> এলসি হলে ব্যাংকে যোগাযোগ করে EXP ফর্ম ও এলসির কপি
সংগ্রহ করা> পন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা এবং c&f এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া>
ডকুমেন্ট ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা বুঝে নেওয়া।
রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধা
রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে সরকার কোনো রপ্তানির ওপর ট্যাক্স ধার্য করে না, বরং কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, পোশাক রপ্তানিতে সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর্তুকি দেয়, যা রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা যায় এমন পন্য এবং গন্তব্য দেশসমূহ।
রপ্তানি ব্যবসা লাভজনক এবং দীর্ঘমেয়াদে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু এই ব্যবসায় প্রবেশ করার আগে এবং প্রতিটি ধাপে সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। রপ্তানি লাইসেন্স থেকে শুরু করে পণ্য পাঠানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মনোযোগী হতে হবে।
আপনার পন্যের মানের দিকে বেশি
মনোযোগী হতে হবে। এতে নতুন নতুন কাস্টমার যেমন পাবেন তেমনি রিপিট কাস্টমারও পাবেন।
যদি আপনার আরও কোনো প্রশ্ন থাকে বা বিশেষ কোনো বিষয় জানার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন।
ধন্যবাদ।
চীন থেকে বাংলাদেশে পন্য আমদানী করার নিয়ম।