বাংলাদেশের উঠতি ব্যবসাগুলোর
মধ্যে সুপার শপ ব্যবসা অন্যতম একটি। সুপারশপ হলো একটি সেলফ সার্ভিস শপ যেখানে এক ছাদের
নিচে বাসা-বাড়ির সব ধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। এই সেবা সহজলভ্যতা এবং ফিক্সড
প্রাইসের সুবিধার কারণে সুপারশপে কেনাকাটার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে
শহর এলাকায় বড় একটি জনসংখ্যা তাদের নিয়মিত বাজার সদাই সুপার শপ গুলোর মাধ্যমে করে
থাকেন, যা কেনাকাটাকে আরও সাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় সুপার
শপের চাহিদা থাকলেও বেশিরভাগ স্থানে কাছাকাছি কোনো সুপার শপ নেই। অর্থাৎ শহর এলাকায়
সুপার শপ ব্যবসার ভাল সম্ভাবনা আছে।
আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হল
সুপার শপ ব্যবসা কেন করবেন, সুপারশপ ব্যবসা করতে কত টাকা লাগবে, সুপারশপ ব্যবসা কিভাবে
শুরু করবেন, প্রতিযোগিতায় কিভাবে টিকে থাকবেন ইত্যাদি বিষয়াবলি।
সুপারশপ ব্যবসা কেন করবেন?
২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের
শহরাঞ্চলের মানুষদের সুপারশপে কেনাকাটার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে,
শহরাঞ্চলে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত সুপারশপের সংখ্যা কম। কিছু সুপারশপে শুধুমাত্র উচ্চমূল্যের
পণ্য থাকায় সাধারণ মানুষ সেখানে কেনাকাটা করতে পারে না।
বর্তমানে, অফলাইনের পাশাপাশি
অনলাইনে সুপারশপ পরিচালনার সুবিধার কারণে গ্রাহকরা সহজেই কেনাকাটা করতে পারছেন, যা
সুপারশপের গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন
থেকে জানা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে সুপারশপ ব্যবসা প্রতিবছর ২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থাৎ এ ব্যবসাটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি ব্যবসা।
কিভাবে শুরু করবেন সুপার
শপ ব্যবসা?
যেকোনো ব্যবসা শুরু করার জন্য
প্রথমেই দরকার একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ। প্রথমে আপনার পুঁজির পরিমাণ বিবেচনা করে
বাকি পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। স্থান নির্বাচন: আপনার ব্যবসার লোকেশন নির্বাচন
খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন স্থানে সুপারশপ শুরু করার চেষ্টা করুন যেখানে আশেপাশে কোনো
সুপারশপ নেই এবং যেখান থেকে যাতায়াত সহজ। বিশেষ করে মেইন রোডের পাশে এমন জায়গা বেছে
নিন যা সহজেই মানুষের নজরে আসে।
নাম নির্বাচন:
ব্যবসার জন্য একটি আকর্ষণীয় নাম নির্বাচন করুন, কারণ সুপারশপ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের
নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর।
স্পেস ভাড়া নিয়ে ডেকোরেশন শেষ
করে পণ্য উঠানো শুরু করুন। এর মাঝে সরকারি বৈধ কাগজপত্র ঠিক করে নিন। এরপর বিজ্ঞাপন
প্রচার করে ব্যবসা শুরু করুন।
সংক্ষিপ্তে বলতে ধাপগুলো এরকমঃ পরিকল্পনা
→ স্থান
নির্বাচন → নাম নির্বাচন → স্পেস
ভাড়া → ডেকোরেশন
→ সরকারি
কাগজপত্র → পণ্য সংগ্রহ → কর্মচারী
নিয়োগ → বিজ্ঞাপন
প্রচার → ব্যবসা
শুরু করা।
সুপার শপ ব্যবসা দুইভাবে করা
যায়। প্রথমত, আপনি নিজে নতুন একটি সুপারশপ প্রতিষ্ঠা করে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবসা
পরিচালনা করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আপনি অন্য কোনো সুপারশপ ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি
কিনে নিতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সুপারশপ ব্র্যান্ড তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি
দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, "স্বপ্ন" সারা দেশে বিনামূল্যে ফ্র্যাঞ্চাইজি দিচ্ছে।
এতে করে যে কেউ স্বপ্নের আউটলেট চালু করতে পারবে এবং সেখানকার লাভের অংশ নিতে পারবে,
তবে সব পণ্য স্বপ্ন থেকে নিতে হবে।
এতে স্বপ্ন কর্তৃপক্ষ যেমন
লাভবান হয়, তেমনি এই সিস্টেমটি ব্যবসায়ীর জন্যও সুবিধাজনক। স্বপ্ন লাভবান হয় কারণ তাদের
পণ্যই বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীও লাভবান হন কারণ স্বপ্নের মতো একটি বড় ব্র্যান্ডের
নামে ব্যবসা করলে স্বাভাবিকভাবেই কাস্টমার বেশি আসে।
সুপারশপ ব্যবসা শুরু করতে
কত টাকা লাগে?
সুপারশপ ব্যবসা শুরু করতে প্রয়োজনীয়
পুঁজির পরিমাণ নির্ভর করে ব্যবসার আকার, অবস্থান, এবং ডেকোরেশনের মানের উপর। এখানে
একটি সম্ভাব্য বাজেটের ধারণা দেওয়া হলো:
১. স্পেস ভাড়া ও এডভান্স
- লোকেশন: ব্যবসার অবস্থানের
উপর ভিত্তি করে ভাড়া ও এডভান্সের পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।
- প্রতি বর্গফুট ভাড়া (ঢাকার মতো শহরে):
প্রতি বর্গফুটে ৮০ থেকে ২০০ টাকা। এই সংখ্যা ক্ষেত্রবিশেষ আরও বেশি হতে পারে।
- এডভান্স: ৩ থেকে ১২ মাসের ভাড়া
অগ্রিম দিতে হতে পারে, যা হতে পারে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার মধ্যে। এই সংখ্যাও ক্ষেত্রবিশেষ
আরও বেশি হতে পারে।
২. ডেকোরেশন খরচ
- মাঝারি মানের ডেকোরেশন: ৫
থেকে ১০ লাখ টাকা।
- উচ্চমানের ডেকোরেশন: ১২ থেকে ২৫ লাখ টাকা।
- ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, চেকআউট কাউন্টার,
ফ্রিজার, শেলভিং ইত্যাদি: ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা।
৩. সরকারি কাগজপত্র ও লাইসেন্স ফি
সরকারি কাগজপত্র যেমন ট্রেড
লাইসেন্স, সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন, ফায়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি বাবদ খরচ লাগবে ১
থেকে ২ লাখ টাকা।
৪. পণ্য স্টক
- শুরুর পণ্য স্টক: ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকা
(মাঝারি আকারের সুপারশপের জন্য)।
- বিস্তারিত পণ্য ভ্যারিয়েন্টস: পণ্যের
ভ্যারিয়েন্ট ও পরিসরের উপর খরচ বাড়তে পারে।
৫. কর্মচারী বেতন ও প্রশিক্ষণ
- প্রতি কর্মচারীর বেতন: ১৫,০০০ থেকে ২৫,০০০
টাকা (বেতন স্কেল ও পজিশনের উপর নির্ভর করে)।
- প্রথম ৩ মাসের বেতন: ২ থেকে ৪ লাখ টাকা
(৬ থেকে ৮ জন কর্মচারীর জন্য)।
- প্রশিক্ষণ খরচ: ৫০,০০০
থেকে ১ লাখ টাকা।
৬. বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা
- প্রচারণার জন্য প্রাথমিক বাজেট: ১ থেকে
৫ লাখ টাকা (স্থানীয় ও অনলাইন বিজ্ঞাপনের জন্য)।
- ওয়েবসাইট ও অনলাইন অর্ডার সিস্টেম: ৫০,০০০
থেকে ২ লাখ টাকা।
৭. অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ
- ইলেকট্রিসিটি, পানি, এবং ইউটিলিটি বিল:
মাসে ৩০,০০০ থেকে ১ লাখ টাকা।
- সিকিউরিটি ও মেইনটেন্যান্স খরচ: ৫০,০০০
থেকে ২ লাখ টাকা।
মোট খরচের একটি ধারণা:
সাধারণত, একটি মাঝারি আকারের
সুপারশপ ব্যবসা শুরু করতে ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তবে, প্রিমিয়াম
লোকেশনে বা বড় পরিসরে ব্যবসা শুরু করতে চাইলে এই বাজেট ৭৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মধ্যে
হতে পারে।
এই খরচের পরিমাণ আপনার ব্যবসার
ধরন, অবস্থান, এবং পরিকল্পনার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। সঠিক বাজেট পরিকল্পনা
ও খরচের হিসাব করে নেয়া উচিৎ, যেন ব্যবসার শুরু থেকেই আপনি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে
পারেন।
যদি আপনি ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে ব্যবসা করতে চান, তাহলে আপনার খরচ চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। সাধারণত, ফ্র্যাঞ্চাইজি গ্রহণের ক্ষেত্রে পূঁজি কিছুটা কম হতে পারে, কারণ আপনি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নাম এবং সাপোর্ট পাচ্ছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করার সুবিধা হলো, আপনি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের অংশ হয়ে যাচ্ছেন, যা আপনার ব্যবসার প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়ায় এবং শুরুতেই কিছুটা মার্কেটিং সাপোর্ট প্রদান করে।
ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সিঃ লাভজনক ব্যবসা শুরু করার সম্পূর্ন পরিকল্পনা
সুপারশপ ব্যবসায় টিকে থাকার কৌশল
বাংলাদেশে সুপারশপ ব্যবসা একটি
উঠতি এবং প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ
কৌশল অনুসরণ করা উচিত:
১. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কম রাখা
মূল্যসীমা: পণ্যের
দাম কম রাখলে ক্রেতা আকৃষ্ট হয়।
মূল্যছাড়ের অফার: নিয়মিত
ডিসকাউন্ট অফার দিন।
ডিরেক্ট সোর্সিং: পাইকারদের
মাধ্যমে না কিনে সরাসরি উৎপাদনকারীর কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করুন। এটি মিডলম্যানের খরচ
কমিয়ে দেবে এবং দাম কম রাখবে।
২. ডেকোরেশন ও সজ্জা
টেকনিক: সুপারশপের
ডেকোরেশন এমনভাবে করুন যেন ক্রেতারা এক পণ্য কিনে পরবর্তী পণ্যের দিকে আকৃষ্ট হন।
ফ্লো: পণ্যগুলি
এমনভাবে সাজান যাতে ক্রেতা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সহজে যেতে পারে এবং নানা পণ্য
দেখতে পায়।
৩. অফলাইন এবং অনলাইন ব্যবসা
ওয়েবসাইট: একটি
ওয়েবসাইট তৈরি করুন যেখানে গ্রাহকরা অনলাইনে পণ্য অর্ডার করতে পারে।
অনলাইন প্রচারণা: সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপনার ব্যবসার প্রচারণা করুন।
চীন থেকে বাংলাদেশে পন্য আমদানি করার নিয়ম
৪. প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হওয়া
মূদী দোকান ও অন্যান্য দোকানের
সঙ্গে প্রতিযোগিতা: আশেপাশের মূদী দোকান ও অন্যান্য ছোট দোকানের সঙ্গে সরাসরি
প্রতিযোগিতা করতে হবে। এজন্য আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার সুপারশপে সব ধরনের প্রয়োজনীয়
পণ্য এবং সেবা আছে।
৫. কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স
গ্রাহক সেবা: ভালো
গ্রাহক সেবা প্রদান করুন এবং ক্রেতাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখুন।
মেম্বারশিপ প্রোগ্রাম: নিয়মিত
ক্রেতাদের জন্য মেম্বারশিপ অফার করুন, যা বিশেষ ছাড় ও সুবিধা প্রদান করবে।
কি কি পন্য বিক্রি করা
যায় সুপারশপে?
মাছ তরকারি থেকে শুরু করে ছোটোখাটো
ইলেকট্রনিক্স পন্য, জামাকাপড় পর্যন্ত বিক্রি হয় সুপারশপে।
একটি সুপারশপে পন্যের ভ্যারিয়েন্টের
উপর ভিত্তি করে কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়। সুপারশপে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি
হয়, যা নিম্নলিখিতভাবে সাজাতে পারেন:
খাদ্য পণ্য: মাছ,
তরকারি, মাংস, এবং অন্যান্য কাঁচা খাদ্যদ্রব্য একটি বিশেষ জোনে রাখতে পারেন।
ঘরোয়া প্রয়োজনীয় পণ্য: সাবান,
কসমেটিক্স, এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী একটি আলাদা জোনে রাখবেন।
মূদি পণ্য: বিভিন্ন
মূদি আইটেম যেমন চিনি, চাল, ডাল, মশলা ইত্যাদি।
বেকারি পণ্য: পেস্ট্রি,
কেক, মিস্টি, দধি ইত্যাদি।
বাচ্চাদের খেলনা: বিভিন্ন
ধরনের খেলনা ও শিশুর প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
কুকওয়ার আইটেম: রান্নার
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন কুকিং পট, প্যান, ইত্যাদি।
ইলেকট্রনিক্স পণ্য: ব্লেন্ডার,
ইলেকট্রিক বিটার, ট্রিমার ইত্যাদি।
স্টেশনারি আইটেম: বিভিন্ন
ধরনের স্টেশনারি সামগ্রী যেমন কাগজ, পেন্সিল, ইত্যাদি।
প্রতি সুপারশপে এই পণ্যের ভ্যারিয়েন্টের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জোন তৈরি করা হয়, যাতে গ্রাহক সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য খুঁজে পেতে পারেন।।
বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দিয়ে বৈধভাবে আমদানি কতটা সম্ভব?
আজকের আলোচনা থেকে কোনো প্রশ্ন
বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট করবেন।
ধন্যবাদ।