যখন ছোটবেলায় স্কুলে স্যাররা জিজ্ঞাসা করতেন বড় হয়ে কে কী হবে, তখন নিজের সিরিয়াল আসার আগে কান খাড়া করে শুনতাম বাকিরা কি বলে।
বেশিরভাগই উত্তর দিত হয় ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার। কদাচিৎ কেউ বলত পাইলট (আমি এই দলভুক্ত) বা শিক্ষক হবে।
এরপর যখন
আরেকটু বড় হলাম, দেখতাম অনেকেরই আগের বলা উত্তর পাল্টে যাচ্ছে। আমি নিজে
ককপিট (পাইলট) ছেড়ে গায়ে সাদা অ্যাপ্রন জড়াতে চাইলাম, মানে এবার ডাক্তার
হতে চাই।
তারপর
বিশ্ববিদ্যালয় আসার পর বন্ধুদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা দেখতাম, কেউ বিভাগের
শিক্ষক হবে, কেউ জিআরই বা আইইএলটিস দিবে, বাকিরা চোখ কান বুঝে বিসিএস
(বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস)।
বন্ধুদের মধ্যে আমার মাথায় একটু উদ্ভট চিন্তা ভাবনা কাজ করত।
গায়ের সাদা
অ্যাপ্রন অনেক দিন হল খুলে রেখেছি, এখন লম্বা চুল, মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ,
গায়ে পাঙ্খা শার্ট-জিন্স পরে ডুকাটি বাইক নিয়ে ছুটছি নিজের আইডিয়ার
পিছে—উদ্যোক্তা হব।
আমার হলে,
পাশের হলে মিলিয়ে আরও দু/চারজনকে পেলাম যারা ব্যবসার দিকে আগ্রহ দেখাল।
কয়েক দফা একসাথে বসে ঠিক করা হল প্রতি মাসে নিজেরা কিছু টাকা জমা করে করে
একটা ফান্ড হলে ব্যবসা শুরু করব।
তখন আমার
মাথায় প্রচুর আইডিয়া ঘুরতো। আমি ফাল পেড়ে আইডিয়া দিতাম আর বলতাম আমাদের
এক্ষুণি শুরু করা উচিত। টাকা জমা করে না রেখে খাটানোই ভালো হবে।
ওদের
বক্তব্য থাকতো এমন, "ব্যবসা শুরু করতে গেলে অনেক ক্যাপিটাল (মূলধন) দরকার।
আগে অনার্স পাশ করে একটা চাকরি নেই, তারপর টাকা জমিয়ে ব্যবসা শুরু করব"।
পাল্লা
একদিকে ভারী হয়ে গেল। কোনো উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত শুরুর মুখ দেখল না। ওরা
বিসিএসের দিকে ছুটতে শুরু করল আর আমি অসহায় উদ্যোক্তা একা পড়ে গেলাম।
'রিচ ড্যাড, পুওর ড্যাড' বইতে রবার্ট কিওসাকি বলেছেন আমাদের চাকরি করার জন্য মূলত দুটি কারণ কাজ করে—ভয় এবং লোভ।
আমার বন্ধুদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আগে একটা সরকারি চাকরি নেয়ার পিছনে সবার আগে কাজ করে এই ভয়।
বাবা-মা
এতদিন তিল তিল করে বড় করেছে, যত দ্রুত পারা যায়
তাদের সংসারের ভার নেয়া
দরকার। একটি সরকারি চাকরি মানেই নিশ্চয়তা, মাস শেষে একটি নিশ্চিত অর্থের
যোগান, বাসা বাড়ির সুবিধা, সমাজে ভরপুর সম্মান।
মরে টরে গেলেও ভয় নেই—আমাদের আসল বাপ-মা (সরকার), আমাদের বায়োলজিক্যাল বাবা-মাকে দেখবে।
যাই হোক,
এর মধ্যেও দু/চার জনের মধ্যে ব্যবসার ভূত জাগে- যখন তাদের পকেটে টান পড়ে,
বউয়ের সাথে নতুন ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে দুবেলা ঝগড়া বাঁধে, তখন কেউ কেউ ভাবে,
"নাহ! এই চাকরি দিয়ে আর পোষাচ্ছে না, একটা ব্যবসা শুরু করা দরকার।" খেয়াল
করুন তার মধ্যে প্রত্যাশা জন্মেছে।
প্রত্যাশা? হা? প্রত্যাশা ভালো জিনিস! কিন্তু টুটি চেপে ধরার মোক্ষম অস্ত্রও সরকারের গোডাউনে মজুদ আছে—প্রোমোশন।
দুইটা থানার সহকারী পুলিশ সুপার চাকরি ছেড়ে দেবে বলতেছে? দাও, ওর হাতে পুরো জেলাটাই তুলে দাও। ব্যস! লোভ ধরিয়ে দিল।
পুলিশ সুপারের কত্ত ক্ষমতা! বউ খুশি? আবার জিগায়!
বউ খুশ তো জিন্দেগি খুশ, আর কি চাই? (কক্সবাজার একটা ট্যুর দিয়ে আসা যায়, খুশকির সাথে সাথে ব্যবসার ভুতটাও মাথা থেকে ধুয়ে যাক! ????????)
তাহলে উদ্যোক্তা কেন তৈরি হচ্ছে না?
মাস শেষ, পকেট খালি? খাবো কি? দাঁড়াবো কই? এই ভয়টা আমরা বেশীরভাগই কাটাতে পারি না। যা দু চারজন পারে তারাও পরে লোভের ফাঁদে পা দেয়।
স্কুলের
ক্লাসরুমে বসে আমরা শিখি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কোনো ক্যারিয়ার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় এসে দেখি সিভিল সার্ভিস ছাড়া গতি নেই। ক্যাডার না হলে তাকে
মানুষ মনে করা হয় না।
সহজ কথায় উত্তর হল—খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের মগজ ধোলাই করা হয়।
উদ্যোক্তা
হওয়া খুব কঠিন। একটি চাকরি পাওয়া যতটা না কঠিন, উদ্যোক্তা হওয়া তার তুলনায়
শতগুণে কঠিন। অধিকাংশেরই তাই উদ্যোক্তা হওয়ার মতো ঝুঁকি নেয়ার সাহস হয় না।
ধোলাই করা মগজ নিয়ে কতদূর যাইতে বলেন?
যা দু/চারজন কোনো উদ্যোগ নিতে যায়, একটা হোঁচট খেলেই সব তালগোল পাকিয়ে উদ্যোগের সমস্ত বাজে চিন্তা-ভাবনা হজম হয়ে যায়।
দু/তিনটা গোত্তা খেয়ে আবার চাকরির বই হাতে পড়ার টেবিলে নিজেকে খুঁজে পাই।