বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয়গুলোর
মধ্যে মূদ্রাস্ফিতি (Inflation) গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। সম্প্রতি বিশ্বের বেশ কয়েকটি
দেশে ব্যাপক হারে মূদ্রাস্ফিতি দেখা যাচ্ছে।
আজ আমরা, মুদ্রাস্ফিতি কি,
মুদ্রাস্ফিতি কিভাবে হয়, মূদ্রাস্ফিতির ভালো দিক খারাপ দিক, বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফিতির
অবস্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
মূদ্রাস্ফিতি কি?
মূদ্রার মান কমে গেলে তাকে
মূদ্রাস্ফিতি বলে। আজ থেকে ২০ বছর আগে একটা পাঁচশত টাকার নোট দিয়ে যা ক্রয় করা যেত
এখন তা ক্রয় করতে আরও অনেক বেশি টাকা লাগে। ২০ বছর আগে যেই কাজের জন্য দশ হাজার টাকা
বেতন দেওয়া হত এখন সেখানে আরও বেশি টাকা বেতন দিতে হয়। ২০ বছর আগে একটা ১০০ টাকার নোটকে
অনেক বড় নোট ধরা হত, এখন ১০০ টাকা দিয়ে ২কেজি চালও কেনা যায় না। সব কিছুর দাম-খরচ বাড়তেই
থাকে। সামগ্রিক ভাবে যখন সবকিছুর দাম বাড়ে তখন টাকার মান কমে।
আর একটা কথা বলি পন্যের দাম
বাড়লেই মূদ্রাস্ফিতি হয় না। কখনও বাজারে হঠাৎ কোনো কিছুর দাম বেড়ে যায়। যেমন ধরুন হঠাৎ
চালের দাম বেড়ে ২০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়ে গেল। এই দাম আবার কমে ২০ টাকা এমনকি
১৫ টাকাতেও নেমে আসতে পারে। এখানে মুদ্রাস্ফিতির কারনেই দাম বেড়েছে বিষয়টা এমন নয়।
এখানে অন্যান্য কারন যেমন বাজারে সংকট বা অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিও হতে পারে।
সাধারনত মূদ্রাস্ফিতির হার
৩% থেকে ৬% বা আরও কম থাকলে তাকে স্বাভাবিক বলা যায়। যখন মূদ্রস্ফিতির হার এর চেয়ে
বেশি হয় তখন দেশে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
মূদ্রাস্ফিতি কিভাবে হয়?
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে
মূদ্রার মান কমলে মূদ্রাস্ফিতি হয়। একটি দেশের মূদ্রার মান বিভিন্নভাবে কমে।
মূদ্রাস্ফিতি তথা টাকার মান
কিভাবে কমে এটা বুঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলাম…
উদাহরণ ১.
ধরুন বাজারে জ্বালানি তেলের
সংকট। সাধারনত চাহিদার চাইতে পন্যের যোগান কম হলে পন্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থাৎ বাজারে
তেলের সংকট তাই তেলের দাম বেড়ে গেছে। তেলের দাম বাড়ার কারনে পরিবহন সেক্টরে ভাড়া বেড়ে
যাবে।
এতে পন্য বাজারজাত ব্যবস্থায়
পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাবে সাথে বৃদ্ধি পাবে অন্যান্য পন্যের দাম।
উদাহরণ ২.
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে
বিশ্বব্যাপি নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশের
অর্থনীতি যেসব পন্যের উপর নির্ভরশীল সেসব পন্যের দাম তেমন একটা বাড়েনি বরং কোনো ক্ষেত্রে
কমেছে। যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা রেডিমেইড গার্মেন্টস (RMG) আইটেমের উপর নির্ভরশীল।
এ ধরনের পন্যের দাম তেমন একটা বাড়েনি। অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি আয় যেটুকু বৃদ্ধি পাওয়ার
কথা তা বৃদ্ধি পায়নি।
অন্যদিকে যেসব পন্য আমদানি
করতে হয় সেগুলোর (জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, গম, চাল, পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল,
মেশিনারিজ আইটেম ইত্যাদি) দাম অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর কারনে ডলারের একটা সংকট
তৈরি হয়েছে। এই সংকটের কারনে ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে
আমদানি খরচ আরও বেড়ে শেষে পন্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে প্রায় সকল পন্যের দাম বৃদ্ধি
পেয়েছে। অর্থাৎ টাকার মান কমেছে।
উদাহরণ ৩.
সাধারনত সময়ের সাথে মানুষের
আয় বৃদ্ধি পায়। আয় বৃদ্ধি পাওয়া মানে ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া। যদি দেশের সবারই ক্রয়
ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাহলে চাহিদা বেড়ে গিয়ে পন্যের দাম বেড়ে যাবে।
ধরুন এবছর আপনার বেতন ১০
হাজার টাকা থেকে ১৩ হাজার টাকা হল। তাহলে এখন আপনি আর একটু ভাল ভাবে চলার চেষ্টা করবেন।
আগে দিনে দুই বেলা খাবার খাইতেন, এখন ৩ বেলা খাবেন। এভাবে বেতন কিন্তু আপনার একা বাড়ে
নি। অন্যান্য যাদের বেতন বেড়েছে তারাও ২বেলার স্থানে ৩বেলা খাবার খাবে।
এদিকে একটা বিষয় খেয়াল করুন
আপনার বেতন বেড়েছে, কিন্তু দেশে খাবার উৎপাদন বাড়ে নি। তাহলে আপনাদের যাদের বেতন বেড়েছে
তাদের মধ্যে খাবারের চাহিদা ৩বেলার কিন্তু উৎপাদন আছে ২বেলার। তাহলে ঐ ২ বেলা খাবার
এর দাম বেড়ে যাবে। দিন শেষে আপনাদেরকে বাড়তি বেতন দিয়ে ২বেলা খাবারই খেয়ে থাকতে হবে।
উপরে মূদ্রাস্ফিতির সাধারন
৩টি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। তবে আরও বিভিন্ন ভাবে মূদ্রাস্ফিতি হয়। যেমন ঋন খেলাপি,
টাকা পাচার ইত্যাদি। একেক দেশে মুদ্রাস্ফিতি হয় একেক কারনে। তবে মাঝে মাঝে কোনো দেশে
টাকার মান না কমে বাড়ে।
মূদ্রাস্ফিতি হলে সমস্যা
কি?
মূদ্রাস্ফিতির প্রভাব জনসাধারনের
মধ্যে মারাত্মকভাবে পড়ে। অল্প মাত্রার মূদ্রাস্ফিতি যা ৪-৫% এর মধ্যে থাকে তা অর্থনীতির
জন্য ভাল। মূদ্রাস্ফিতি সীমার মধ্যে থাকলে তা বিনিয়োগ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
মূদ্রাস্ফিতির কারনে জনসাধারনের
আয় বাড়লেও জীবনযাত্রার উন্নতি হয় না। যখন মূদ্রাস্ফিতির হার মানুষের আয় বৃদ্ধির হার
থেকে বেশি হবে তখন জীবনযাত্রার মানের অবনতি হবে।
মূদ্রাস্ফিতির কারনে স্থির
আয়ের মানুষ বিপদে পড়ে। আর যারা ব্যবসায়ী তারা লাভবান হয়। মূদ্রাস্ফিতির কারনে গরিবের
সম্পদ ধনীদের হাতে চলে যেতে থাকে।
যখন মূদ্রাস্ফিতির হার অনেক
বেশি হয় তখন মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে চায় না। কারন ব্যাংকে সুদ দেয় ৩ থেকে ১০/১১ শতাংশ।
মূদ্রাস্ফিতির হার এর চাইতে বেশি হলে ব্যাংকে টাকা রাখলে লোকসান গুনতে হবে। তাই ব্যাংকগুলো
ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাবে। (এরকমটা হয় যদি মূদ্রাস্ফিতির হার অনেক বেশি হয়)
মানুষ টাকা সঞ্চয় করবে না।
কারন অধিক মূদ্রাস্ফিতির কারনে টাকা সঞ্চয় নিরাপদ না। টাকা সঞ্চয় কমে গেলে ব্যবসায়
বিনিয়োগ কমে যাবে।
ঋনদাতা ঋন দিবে না।
ব্যবসায় বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীরা
আগ্রহ হারায়। স্বর্ণ ও অন্যান্য জুয়েলারি আইটেমে অথবা জমি কিনে টাকা বিনিয়োগ করবে।
এসব জিনিসে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়া যায় ঠিকই কিন্তু এগুলো উৎপাদনশীল না। উৎপাদনশীলতা
কমলে মূদ্রাস্ফিতি আরও বাড়বে।
একবার ভেনিজুয়েলায় এমন অবস্থা
হয়েছিল যে একটি মুরগি কেনার জন্য ঠেলাগাড়িতে করে বলিভার (ভেনিজুয়েলার মূদ্রা) নিতে
হয়েছিলো। তারা প্রচুর বলিভার (ভেনিজুয়েলার মূদ্রা) দিয়ে ডলার (মার্কিন) কিনে বিনিময়
করত।
মুদ্রাস্ফিতিতে লাভবান কারা
পূর্বেই বলেছি যারা ব্যবসায়ী
তারা মূদ্রাস্ফিতির কারনে লাভবান হয়। তাছাড়া যারা স্বর্ণ, ডায়মন্ড, অন্যান্য জুয়েলারি,
জমি, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে রেখেছে তারা লাভবান হবে।
যারা আমদানি ব্যবসা করে প্রাথমিক
পর্যায়ে তারা লাভবান হবে। কারন মূদ্রাস্ফিতির কারনে দেশে পন্যের দাম বেড়ে গেলেও অন্যান্য
দেশে পন্যের দাম কিন্তু বাড়বে না। তখন ঐ পন্য আমদানি করার চাহিদা বেড়ে যাবে। আমদানি
বেড়ে গেলে অন্যান্য দেশের মূদ্রামানের তুলনায় আমাদের দেশের মূদ্রামান কমে যাবে। ফলে
আমদানি খরচও বেড়ে যাবে।
মূদ্রাস্ফিতিতে ঋনগ্রহীতা
লাভবান হবে। কারন ঋন পরিশোধে যে টাকা ফেরত দিতে হবে তার মান ঋন হিসেবে নেওয়া টাকার
মানের তুলনায় কম।
বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফিতি
হয় কেন?
অতিরিক্ত জনসংখ্যা মূদ্রাস্ফিতির
বড় একটি কারন। দেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই হারে পন্য বা সেবার হার বৃদ্ধি
পায়নি।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফিতি বৃদ্ধি
পাওয়ার বড় একটি কারন হল দেশের মানুষের টাকা বেড়েছে। অর্থাৎ মানুষের আয় বেড়েছে। কিন্তু
সেবা ও পন্য উৎপাদন বাড়েনি।
তাছাড়া বাংলাদেশে পন্য আমদানির
চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই অনুপাতে রপ্তানি হচ্ছে না। যার কারনে অন্যান্য দেশের টাকার
তুলনায় বাংলাদেশের টাকার মান কমছে। ফলাফলে মূদ্রাস্ফিতি।
বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অধিক
পরিমানে ঋন দেওয়া মূদ্রাস্ফিতির বড় কারন। বানিজ্যিক ব্যাংক অধিক পরিমানে ঋন দিলে মানুষের
হাতে বেশি টাকা চলে যায়। যার কারনে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলাফল মূদ্রাস্ফিতি।
ঋন খেলাপির কারনে এবং টাকা
পাচারের কারনে মূদ্রাস্ফিতি হয়। বাংলাদেশে ঋন খেলাপিও বেশি হয় টাকা পাচারও হয় অনেক।
এসব কারনেই মূলত বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফিতি হয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক
দূর্যোগ দেখা যায়। বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি কারনে কৃষি পন্য উৎপাদন কমে যায়।
পন্যের উৎপাদন কম হলে দাম বেড়ে যায়।
বিশ্বব্যাপি জ্বালানি তেলের
দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এটাও বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফিতির
একটা কারন।
দেশে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক
কাজে অনেক টাকা খরচ হয়। বেশিরভাগ প্রজেক্টেই দূর্নীতি হয়। এখানে দূর্নীতির মাধ্যমে
কিছু মানুষ প্রচুর অবৈধ টাকা আয় করে। তারপর এসব প্রজেক্টে যে টাকা খরচ হয় তা জনগন থেকেই
করের মাধ্যমে আদায় করা হয়। জনগনের উপর চাপানো অতিরিক্ত করও মূদ্রাস্ফিতির কারন।
বাংলাদেশে মূদ্রাস্ফিতি
ঠেকাতে করনীয় কি?
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে দেশের
চাহিদা পূরন করে রপ্তানি বৃদ্ধি করলে অনেকাংশে মূদ্রাস্ফিতি কমে যাবে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য
ব্যবসায়ীদেরকে আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে হবে এবং সহজে ব্যবসার জন্য সুযোগ
সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। সাথে পন্য রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য উন্নত মানের পন্য উৎপাদন করতে
হবে।
যখন ব্যবসায়ীদের দেশে বিনিয়োগ
করার আগ্রহ বাড়বে তখন বিদেশে টাকা পাচার কমে যাবে। বাংলাদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ সুবিধাজনক
হলে অন্যান্য দেশ থেকে এখানে বিনিয়োগ আসবে।
ঋন খেলাপি নিয়ে আরও কঠোর
হতে হবে। সাথে দূর্নীতি দমনেও কঠোর হতে হবে।
দেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী
বেশি মুনাফার আশায় কৃত্তিম সংকট তৈরি করে পন্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এজন্য সরকারকে পন্যের
সর্বোচ্চো দাম নির্ধারন করে দিতে হবে।
অতিরিক্ত মূদ্রাস্ফিতি ঠেকাতে
রেমিটেন্স আরও বাড়াতে হবে। বেশি রেমিটেন্স পেতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে।
আজকের আলোচনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন
বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট করবেন।
ধন্যবাদ।